'ইউএস-বাংলাদেশ অ্যাডভোকেসি কাউন্সিল'র আলোচনা সভায় রাষ্ট্রদূত মুশফিক, বার্নিকাট ও মজিনা

"৫ আগস্ট স্বৈরাচার হাসিনার পলায়ন বাংলাদেশের বিপ্লবের ইতিহাসের স্বর্ণালী দিন"

"৫ আগস্ট স্বৈরাচার হাসিনার পলায়ন বাংলাদেশের বিপ্লবের ইতিহাসের স্বর্ণালী দিন"

গোলাম ইউসুফ, ঢাকা

স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পতন বাংলাদেশের বিপ্লবের এক নতুন ইতিহাস তৈরি করেছে। ৫ আগস্ট এক ভিন্ন ধরনের বিপ্লব ঘটেছে বাংলাদেশে। জনগণ এবং রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত গণতান্ত্রিক উত্তরণ এবং সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে সহযোগিতা করা। ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার চলমান সংকট উতরে দেশকে গণতন্ত্রের পথে নিয়ে যেতে কাজ করছে।

শনিবার যুক্তরাষ্ট্রে "ইউএস-বাংলাদেশ অ্যাডভোকেসি কাউন্সিল (ইউবেক)" এর উদ্যোগে "দ্য ফিউচার অব ডেমেক্রেসি এন্ড দ্য রোল অব ইনটেরিম গভর্ণমেন্ট ইন বাংলাদেশ" শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন।

বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত ড‍্যান মজিনা বলেন, "আমি কয়েক বছর হাসিনার শাসন দেখেছি। কিন্তু স্বপ্নেও ভাবিনি খুব সহজে এই সরকারের পতন ঘটবে। আমরা দেখেছি তরুণরা কীনা করতে পারে। তারা জুলাইয়ে এটা করে দেখিয়েছে। ৫ আগস্টকে আমরা কখনো ভুলে যাবোনা।

হেলিকপ্টার উড়ে যাচ্ছিলো (হাসিনার পালানোর জন্য)। এই পতনে ১৫ বছরের স্বৈরশাসনের ইতি ঘটেছে। এই পালিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশ বিপ্লবের দেখা পেয়েছে। এটা বিপ্লবের ইতিহাস।"

তিনি বলেন, "তরুণরা একক কোন দলকে ক্ষমতার সুবিধা দেয়নি, এক স্বৈরাচার সেনা শাসক থেকে আরেক স্বৈরাচার সেনা শাসকের হাতে ক্ষমতা যায়নি বরং ১৫ বছরের স্বৈরশাসনের পতন ঘটানো হয়েছে।"

রাষ্ট্রদূত মজিনা বলেন, "এই বিপ্লব ছিলো ভিন্ন ধরনের একটি বিপ্লব। বিপ্লবের পর কোনো ধরনের বিপর্যয় ঘটেনি বরং স্থিতিশীল গণতন্ত্রের দিকে যাত্রা শুরু হয়েছে। আমি যখন ৫ আগস্টের দিকে তাকাই তখন হেলিকপ্টার দিয়ে পালিয়ে যাবার দৃশ্য দেখি তখন মনে হয় এটা বাংলাদেশের ইতিহাসের বিস্ময়কর ঘটনা।"

তিনি বলেন, "বাংলাদেশের ৫ আগস্ট অন্য একটি কারণে আরও ভিন্নতা পেয়েছে। এই বিপ্লবের পর বিপ্লবের নেতারা ক্ষমতা এবং সিংহাসন নিয়ে মারামারি করেননি। তারা এ বিষয়টি থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন, নিজেদের সীমাবদ্ধতার জায়গাটুকু তারা অনুধাবন করেছেন এবং নেতৃত্বের জন্য নিজেদের বাইরে থেকে একজনকে খুঁজে নিয়েছেন। বিস্ময়কর! এরকম ঘটনা কে শুনেছে? এমনটা পৃথিবীর কোথাও আর ঘটেনি। তারা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নেতৃত্বের জন্য বেছে নিয়েছে। বাংলাদেশের মানুষেরা সত্যিই ভাগ্যবান যে তারা ইউনূসের মত এরকম সৎ, জ্ঞানী এবং নেতৃত্বের যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষকে পেয়েছে।

বাংলাদেশে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। সংকট সমাধানে সংস্কার প্রক্রিয়ার কার্যক্রম চলেছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল হয়েছে এবং দেশটির অর্থনীতি বিকশিত হচ্ছে।"

রাষ্ট্রদূত মজিনা বলেন, "বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো আবার তাদের পুরনো ভুলে ফিরে যাক এটা আমি যুক্তিযুক্ত মনে করিনা। জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশনের কাজ হবে তাদেরকে নৈতিক আচরণের বিষয়ে প্রশিক্ষিত করা।"

তিনি বলেন, "বাংলাদেশের জনগণ এবং রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক প্রক্রিয়া নির্মাণে অন্তর্বর্তী সরকারকে চাপ না দিয়ে সহযোগিতা করা। এর জন্য সময় দেওয়া প্রয়োজন। আমি মনে করি বাংলাদেশের জনগণ সত্যিকারের বিপ্লব এবং এর সফলতা ছাড়া অন্য কিছুকে তারা গ্রহণ করবে না।"

রাষ্ট্রদূত মজিনা বলেন, "বাংলাদেশের রাজনৈতিক পথ নির্মাণ, সংস্কার এবং গণতন্ত্রে যাত্রার পথটি সহজ নয়। তবে ইউনূস সেই ব্যক্তি যিনি বাংলাদেশকে সেই পথে টেনে নিয়ে যেতে পারবেন।"

বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত মার্শা ব্লুম বার্নিকাট বলেন, "গুগল করলে আপনি দেখতে পাবেন বাংলাদেশ সম্ভাবনার সমারোহে পুরস্কৃত। দেশটি শত শত নদী দ্বারা পরিবেষ্টিত। বাংলাদেশ কৃষি এবং বনায়নের উন্নয়নে অংশীদারদের সঙ্গে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ তা প্রশংসনীয়। দেশটি পৃথিবীর অন্যতম চাল এবং পাট উৎপাদনকারী দেশ। বাংলাদেশের কৃষক এবং বিজ্ঞানীরা নতুন নতুন উদ্ভাবনের মাধ্যমে নিজেরা উপকৃত হচ্ছে এবং উদ্ভাবনী সুবিধাগুলো বিদেশে ছড়িয়ে দিচ্ছে। যার মধ্যে রয়েছে বন্যা সহনশীল শস্য। বঙ্গোপসাগরে রয়েছে অপার সম্ভাবনা, এছাড়া বাংলাদেশে প্রচুর মৎস্য খামার রয়েছে।"

তিনি বলেন, "বাংলাদেশের সবচাইতে বড় সম্পদ হচ্ছে দেশটির জনগণ। এদেশের তরুণরা ডাইনামিক। আমার দায়িত্বপালনকালে অভীভূত হয়েছি ২০১৮ সালে। এসময় তরুণরা বাস দূর্ঘটনায় শিক্ষার্থী নিহতের প্রতিবাদে তারা রাস্তায় নেমে আসে। তারা কোনো ভবনে অগ্নিসংযোগ বা ধংসাত্মক কাজ করেনি বরং তারা নিজেরা সুসংগঠিত হয়েছে। তারা রাস্তায় নেমে ট্রাফিকের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে, সুশৃঙ্খলভাবে গাড়ি চলাচলে সহায়তা করে, তারা মন্ত্রী, সরকারি কর্মকর্তাসহ সকলের লাইসেন্স চেক করে, রিকশা, বাস-- এগুলোকে আলাদা লেনে চলতে সাহায্য করে। সত্যি অসাধারণ! যেটা ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব সেটা তারা পালন করে দেখিয়েছে। বাংলাদেশি তরুণদের এই অদম্য স্পৃহাকে আমি পছন্দ করি।

যুক্তরাষ্ট্রে গণতন্ত্র উত্তরণে আধুনিক সময়ের নজিরবিহীন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। আজকের দিনে আমেরিকায়পর্যন্ত ১,৮০০ এর বেশী বিক্ষোভ হচ্ছে । ক্ষমতায়ন শুধু সরকার এবং অঙ্গরাজ্যের বিষয় নয় বরং এটি জনগণের মধ্যে প্রতিষ্ঠার বিষয়।"

রাষ্ট্রদূত বার্নিকাট বলেন, "অভিবাসী যুক্তরাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তারা এ দেশের উন্নয়ন এবং সাফল্যে ভূমিকা রাখছে। প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচ ডাব্লিউ বুশ বলেছেন, অভিবাসী শুধু দেশের অতীত ইতিহাসে ভূমিকা রাখে বিষয়টি এমন নয় বরং তারা ভবিষ্যত উন্নয়নে ভূমিকা রাখে। যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রায়নে অভিবাসীরা যেমন ভূমিকা রাখছে ঠিক তেমনিভাবে বাংলাদেশের গণতন্ত্রায়ন এবং বিনিয়োগে তারা ভূমিকা রাখবে বলে আমি আশা রাখি।"

প্রধান অতিথির বক্তব্যে মেক্সিকোতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মুশফিকুল ফজল আনসারী বলেন, "বছরের পর বছর ধরে পতিত স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা নির্যাতন, ভোট কারচুপি এবং নিষ্ঠুর অত্যাচার করে ক্ষমতার গদি আঁকড়ে ছিলো। জাতিসংঘের সাম্প্রতিক এক মানবাধিকার রিপোর্ট অনুসারে, হাসিনার সরকার বিচারবর্হিভূত হত্যা, গুম এবং বিরোধী রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের ওপর ক্রমাগত নির্যাতনসহ চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত।"

তিনি বলেন, "ভোটাধিকার, মুক্তমত এবং মানবিক মর্যাদার মতো সাধারণ মৌলিক দাবির কারণে এই পতিত স্বৈরাচারের খুনের শিকার হয়েছেন নিরীহ মানুষ, হাজার-হাজার বিরোধী রাজনৈতিক দলের কর্মী, সাংবাদিক এবং সাধারণ মানুষ। আরও মর্মান্তিক হলো জুলাইয়ে তরুণ শিক্ষার্থীদের ওপর পতিত সরকারের নির্যাতন। অধিকার আদায়ের দাবিতে রাজপথে নামায় তাদের অনেককে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। তাদের এই আত্মত্যাগ ভুলার নয়। তারা আমাদের সময়ের নৈতিক মেরুর উদাহরণ।"

রাষ্ট্রদূত মুশফিক বলেন, "আমরা বিশ্বাস করি আন্তর্জাতিকভাবে সমাদৃত শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে শান্তিপূর্ণ এবং গণতান্ত্রিক পথে বাংলাদেশের উত্তরণ ঘটবে। তার নেতৃত্বে সাংবিধানিক পথ, প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্র এবং সকল নাগরিকের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। ইতিমধ্যে ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অর্ন্তবর্তী সরকার দেশকে তার সঠিক রাস্তায় ফিরিয়ে আনতে কাজ শুরু করেছে।"

তিনি বলেন, "১১ টি স্বাধীন কমিশন সুনির্দিষ্ট কর্মপন্থায় তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এই কমিশনগুলো হাসিনা এবং তার ঘনিষ্ট মিত্রদের লটু করে নিয়ে যাওয়া অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনতে তৎপর রয়েছে। দেড় দশকেরও বেশী সময়ে হাসিনা এবং তার সাঙ্গ-পাঙ্গরা যেসব মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে তার বিচার করতে সচ্ছতা নিশ্চিত করেছে কমিশন।"

রাষ্ট্রদূত মুশফিক বলেন, "অর্ন্তবর্তী সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতা প্রতিষ্ঠার কাজ করছে। এরই অংশ হিসাবে দুই দিন আগে লণ্ডনে প্রধান উপেদষ্টা ড. ইউনূসের সঙ্গে বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ফলপ্রসূ বৈঠক হয়েছে। এই বৈঠকটি বাংলাদেশের অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের পথে একটি টার্নিং পয়েন্ট। এছাড়া ফেব্রুয়ারির মধ্যে বাংলাদেশে এবং বিদেশে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন আয়োজনে নির্বাচনী রোডম্যাপ প্রস্তুত করছে সরকার।"

তিনি বলেন, "নির্বাচনের এই সম্ভাব্য তারিখ শুধুমাত্র ক্যালেণ্ডারের পাতার একটি হিসাব নয় বরং এটি দেশের জনগণকে দেওয়া প্রতিশ্রুতির পথে যাত্রা। তাদের ভোট আর চুরি হবেনা, কণ্ঠকে চেপে ধরা হবেনা, বাংলাদেশের ভবিষ্যত ভয়, মিথ্যা আর নির্যাতনের ওপর তৈরি হবেনা বরং তার ভীত তৈরি হবে সত্য, স্বচ্ছতা এবং অংশগ্রহণের ভিত্তিতে।"

রাষ্ট্রদূত মুশফিক বলেন, "আপনি ওয়াশিংটন, কানাডা, যেখানেই অবস্থান করেন না কেন, আপনার মতপ্রকাশ গুরুত্বপূর্ণ। আপনার মতপ্রকাশে বাংলাদেশের চিত্র বিশ্বে প্রতিফলিত হবে। আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে বাংলাদেশ কী ভয় না স্বাধীনতা দ্বারা পরিচালিত হবে। মতপ্রকাশের এই দূতিয়ালি গুরুত্বপূর্ণ।"

আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন কবি, লেখক ও সংগঠক সামছুদ্দীন মাহমুদ। এতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন কপিন স্টেট ইউনিভার্সিটির ডিন প্রফেসর জামাল উদ্দিন। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন ডঃ জামাল উদ্দিন, মেজর (অবঃ) মনজুরুল হক, ডাঃ মাকসুমুল হাকিম, ডাঃ আহমেদ নেওয়াজ খান সেলাল, মুশফিকুর রহমান, শামারুখ মহিউদ্দিন, ইঞ্জিনিয়ার খুরশিদ সাব্বির, স্যাম রিয়া, হাসান চৌধুরী, রফিকুল হক. শামীমা সেলিমুদ্দীন, নওশের আলী প্রমুখ।

অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন মেজর (অবঃ) সাফায়াত আহমেদ ও রাইশা ফারিন ।

অনুষ্ঠানে তরুণদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখেন শামায়লা নারমিন ইরশিয়া এবং ইংরেজী ও বাংলা গান পরিবেশন করেন কনিকা খান।

অনুষ্ঠানে একাডেমিকে শামায়লা নারমিন ইরশিয়া ও মিউজিকে কনিকা খানকে এক্সিসিলেন্স এওয়ার্ড প্রদান করা হয়।