ট্রাম্পের ফের প্রেসিডেন্ট হওয়া নিয়ে বাংলাদেশের উদ্বিগ্ন হবার কিছু নেই

ট্রাম্পের ফের প্রেসিডেন্ট হওয়া নিয়ে বাংলাদেশের উদ্বিগ্ন হবার কিছু নেই

জন এফ ড্যানিলোয়িচ

ডোনাল্ড ট্রাম্পের আবারও ক্ষমতায় ফিরে আসার বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র এবং তার বাইরে কতটা প্রভাব ফেলবে তার হিসেব নিকেষ কষতে উঠে পড়ে লেগেছেন সারা বিশ্বের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। বিশ্বের অন্য যেকোনো দেশের চাইতে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এর প্রভাবটা বাস্তব হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার কারণ নির্বাচনের প্রচারণা শেষদিকে এসে যুক্তরাষ্ট্রের নব নির্বাচিত এই প্রেসিডেন্টের হঠাৎ করেই সোশাল মিডিয়ায় পোস্ট করা একটি বার্তা।

ক্ষমতাচ্যুত (হাসিনা) সরকারের সমর্থকরা এই আশাতে বুক বেঁধেছেন যে ট্রাম্প নির্বাচনে জিতে গেলে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি বদলে যাবে, আর তাদের আবারও ক্ষমতায় ফিরে আসার রাস্তাটা সহজ হবে। তাদের মতো একই চিন্তায় আটকে যাওয়া আরকেটা গ্রুপ বলছে তাদের (হাসিনা সরকারের) ফিরে আসা ঠেকাতে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত কাজ হবে আরও বেশি করে শক্ত পদক্ষেপ হাতে নেওয়া। বাংলাদেশে কি হচ্ছে তা দীর্ঘদিন ধরে পর্যবেক্ষণ করে আসছি, একইসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়নের সঙ্গেও সম্পৃক্ত রয়েছি, ট্রাম্পের জেতার পর কী হতে পারে সেটা নিয়ে অনেকে যেসব পূর্বাভাস দিচ্ছেন তার বাস্তবে তার প্রভাব খুব কমই দেখা যেতে পারে বলে আমার ধারণা।

যারা ভাবছেন ট্রাম্প ক্ষমতায় ফিরে আসায় বাংলাদেশ ইস্যুতে গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রভাব পড়বে তারা আসলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের নব নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের ঘনিষ্ট সম্পর্কের বিষয়টি সামনে রেখে একথা বলছেন। তারা ধারণা করছেন ট্রাম্প প্রশাসন বাইডেন প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা ছুড়ে ফেলবেন এবং বাংলাদেশের ঘটনাপ্রবাহের ওপর ভারতকে স্বাধীনভাবে খবরদারি করতে দিবেন। তারা এই খবরদারিকে যুক্তিযুক্ত মনে করেন!

এটা শুনে অবাক হবার কিছু নেই যে এই কথাগুলো যারা বলছেন তারা হচ্ছেন সেসব লোক যারা মনে করেন বাংলাদেশের জুলাই বিপ্লবের পেছনে যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য বিদেশি শক্তির হাত রয়েছে। এই বিশ্লেষকরা তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা খুইয়ে বসেছেন। কারণ দেশের ভিতরে যেসব ঘটনার কারণে হাসিনাকে দেশ ছেড়ে পালাতে হয়েছে সেসব বিষয়কে তারা বার বার উপেক্ষা করে যাচ্ছেন।

এতে কোনো সন্দেহ নাই যে জানুয়ারিতে যখন ট্রাম্প প্রশাসন তাদের দায়িত্ব বুঝে নেবে তখন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে এবং এই নীতির সঙ্গে জড়িতদের কাজের ধরণ এবং বিষয়ে পরিবর্তন আসবে। আর এসব ইস্যুর মধ্যে নির্বাচনী প্রচারণার সময়টাতে অভিবাসন, ইউক্রেন এবং মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ, বাণিজ্য নীতি নিয়ে জোরেশোরে কথা হয়েছে। সহজ কথায় বলা যায়, ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণায় পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে বাইরের বিষয়ে কম হস্তক্ষেপ করা এবং "আমেরিকা ফার্স্ট" এর প্রচারণা হয়েছে। ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণায় বাংলাদেশ বিষয়টি ছিলো অথবা এটি অগ্রাধিকার ইস্যু ছিলো এমনটি যারা ভাবেন তারা মন্দ ভাবেননি।

সেই ভাবনা মতে, যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতার পালাবদলে বাংলাদেশের সঙ্গে দেশটির দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে কী প্রভাব তৈরি করতে পারে সেটা নিয়ে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের একটু চিন্তা করা উচিত। ঢাকার জন্য ভালো সংবাদ হচ্ছে যে ট্রাম্প প্রশাসন তাদের কাজ পুরোদমে শুরু করতে এবং বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কে প্রভাব ফেলতে পারে এমন নীতি নির্ধারণ করতে এখনো হাতে কয়েকমাস বাকি রয়েছে।

সিনেটে রিপাবলিকানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা সত্ত্বেও ট্রাম্প প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক টিমের কাজ পুরোদমে শুরু করতে ২০২৫ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময় লেগে যেতে পারে। জরুরি অনেক বিষয়ের মধ্যে বাংলাদেশ ইস্যু নতুন এই টিমের কাছে অগ্রাধিকার পাবেনা।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক ইস্যুতে বাংলাদেশের যেকোনো পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে ঢাকার উচিত নিজেদের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া এবং এই নীতি নির্ধারণে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কী প্রভাব পড়তে পারে তা নিয়ে ভাবা। ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতি যেভাবে "আমেরিকা ফাস্ট" কৌশলে এগুবে ঠিক সেইভাবে প্রধান উপদেষ্টা ইউনূসের উচিত "বাংলাদেশ ফার্স্ট" নীতিতে অগ্রসর হওয়া।

অবাধ এবং সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকার  সংস্কার কার্যক্রমের পাশাপাশি হাসিনার গণহত্যার বিচার চালিয়ে যাচ্ছে। তারা এই ম্যান্ডেট বাস্তবায়নে অনঢ়। নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের সাইডলাইনে অনুষ্ঠিত বৈঠকগুলো এই বার্তা স্পষ্ট করে দিয়েছে যে বৃহৎ একটি আন্তর্জাতিক জোট তৈরি হয়েছে যেই জোট অন্তর্বর্তী সরকারকে এই এজেন্ডা বাস্তবায়নে সহায়তা করতে প্রস্তুত। এটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে যুক্তরাষ্ট্র এই জোটে থাকবেনা।

এদিকে একই সময়ে এটাও ঠিক যে, যুক্তরাষ্ট্র এবং বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক সরকার কিংবা প্রধান উপদেষ্টার পর্যায়ের সম্পর্কের চাইতে বেশি কিছু। যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস, এনজিও, সাংবাদিকতা এবং ব্যবসাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অনেক বন্ধু রয়েছে। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এগুলো স্থির প্রভাবক হিসাবে কাজ করবে।

ক্ষমতাচ্যুত হাসিনা সরকারের লোকেরা ভাবছে ১৯৭১ সালে কথা তুলে অথবা সাম্প্রতিক সময়ে উত্থাপিত কথিত ষড়যন্ত্রের অভিযোগ সামনে এনে ওয়াশিংটন সুবিধা বাগিয়ে নিতে পারবে। অন্তর্বর্তী সরকারের কেউ এমনটা করবে এটা এক প্রকার অসম্ভব। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আরেকটি স্থির প্রভাবকের ভূমিকা পালন করছেন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত বাংলাদেশি প্রবাসীরা। বাংলাদেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যে লড়াই চলছিলো তার সামনের সারিতে ছিলেন এই প্রবাসীদের অনেকেই। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে এগিয়ে নিতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হাতে একটি সুযোগ রয়েছে। দ্বিপাক্ষিক সম্মান এবং বুঝাপড়ার ভিত্তিতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতির নীতি নির্ধারকদের উচিত ওয়াশিংটনে এমন কাউকে রাষ্ট্রদূত হিসাবে নিয়োগ দেওয়া যিনি এ সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। সম্পর্ক জোরদারের প্রচেষ্টা হিসেবে নব নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে পাঠানো প্রধান উপদেষ্টা ইউনূসের শুভেচ্ছা বার্তাটি হলো প্রথম পদক্ষেপ।

ঢাকায় বসে যারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নিয়ে চিন্তা করছেন তাদের প্রতি আমার একটা পরামর্শ রয়েছে।আমাদের বৃটিশ বন্ধুদের মতো করে তাদেরকে বলতে চাই, "চুপ থাকুন এবং যার যার কাজ চালিয়ে যান।"

[দ্য ঢাকা ট্রিবিউনে পররাষ্ট্রনীতি বিশ্লেষক এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ডেপুটি মিশন প্রধান জন এফ ড্যানিলোয়িচের লেখা মতামতটি জাস্ট নিউজ পাঠকদের জন্য অনুবাদ করেছেন গোলাম ইউসুফ]