স্পন্দন তাহসান

কাকতাড়ুয়ার হাসি

কাকতাড়ুয়ার হাসি

গারো পাহাড়ের ধারে, টাঙ্গাই নদীর পাড়ে, যে অতিকায়, আদিমকালের বটগাছ অর্ধেক পাহাড়, অর্ধেক নদীর উপর কাত হয়ে শুয়ে পুরা এলাকাটার উপর মুরুব্বীর মত নজরদারি করতেছে; যে গাছ পুরা এলাকাটারে থমথমে বানায় রাখছে এবং গাছের নীচ দিয়া গেলে কেমন জানি শীত শীত ভাব ধরে; ফলাফলস্বরুপ গ্রামের লোকজন যেই এলাকাটারে এড়ায়েই যাওয়ার চেষ্টা করে, পাছে জিনে ধরে; আর যেহেতু এখানে গারোরা থাকতো আগে, বিশ্বাস করতো গারো মানুষেরা মারা গেলে এইখানেতে ফেরত আসে, কুফরি করার ভয়ে পরহেজগার মানুষেরাও বটগাছের যেদিকটায় যায় না - সেই বটগাছের তলে এক গর্ত আছে। লোকে বলে, গর্তে মনের দুঃখ বলে বালু চাপা দিলে মনের দুঃখ নাকি কমে। লোকে বলে ঠিক, কিন্তু বিশ্বাস করে কি না বলতে পারি না। গ্রামের যুবসমাজ সুনসান নীরবতার সদ্ব্যবহার করে; গর্তে বালু কম, ফুটকা-বেলুন আর আধ-খাওয়া গাজাই পাওয়া যায় বেশি।

মাঝরাতে, আমার বুক মাঝে মাঝে হাঁসফাঁস করে, এই ডাক্তার দেখাই, ওই কবিরাজ দেখাই, কেউ কোনো বাতিক খুঁইজা পায় না। কিন্তু ওইসব রাতে, আমি নিজেরে হারায় ফেলি। মনে হয় কোথাও ডুবে যাই, ভাইসা যাই, জগত সংসারের কোন কূল কিনারা পারি না করতে। এই রোগ আমার ছোট থেকেই। কেউ বোঝে না, কেউ জানে না কী হয় আমার, কেন এমন হয়। 

নানা থাকলে আমারে কিছুটা হইলেও বুঝতেন হয়তোবা। নানারে দেখি নাই, কিন্তু নানার দর্শনের গুণ-গান শুনছি ম্যালা। সকালে উঠেই নাকি চারদিকে সিজদা দিতেন। চল্লিশ বছর কোন বিদেশ বিভুইয়ে পড়ে থেকে আইসা বিয়া করলেন নানীরে। আবার ত্রিশ বছরের জন্য চম্পট। কেউ কেউ তো বলে, অলৌকিক ক্ষমতাও নাকি ছিল তার কিছু। এমনকি, এই যে বটগাছ নিয়া এত মাতামাতি- এর কিছুটা কৃতিত্ব তো নানারই। নানাও নাকি আসতেন মাঝে মাঝে, এই বটগাছের কাছে। এত কিছু জানে যেই লোক, জগত নিয়ে এত কিছু ধারনা রাখে যে, সুদূর পারস্য থেকে হিমালয়, সবই যে লোকের দেখা -সে তো অবশ্যই কিছু কিছু উত্তর দিতে পারতেন আমার। এই যেমন, বাছিতরে যখন ওর ভাইয়ে কোপ দিয়া দুই ফল্লা কইরা ফেলল, তখন তো আমি আত্মা দেখলাম না কোনো। মানুষের আত্মা কই থাকে? এটা কি উনি জানতেন না? অবশ্যই জানতেন। আমার এই প্রশ্নগুলা কেউ গুরুত্বের সাথে নেয় না। কিন্তু আমি তো জানি আমার ভেতরটা কেমন জট পাকায় যায়, এমন সব রাতে। আমি তখন বটগাছটার ধাঁরে গিয়া দাঁড়াই, বটগাছ তার নিঃশ্বাস ফেইলা আমার গেঞ্জির ভেতর ঢুইকা আমার পিঠে হাত বুলায় দেয় যেনবা। আস্তে আস্তে জটগুলা খুলতে শুরু করে।

এমনই এক রাত্রে গেছিলাম বটগাছটার ধাঁরে, নক্ষত্রদের জিগাইতে, কেন এমন হয়। চাঁদ সেদিন অনুপস্থিত, জোনাকি আর ঝিঝি পোকা ঝিকমিক। জোনাকি আর নক্ষত্ররা পাল্লা দিতেছিল কে বেশি আলো ছিটাইতে পারে। বটগাছের নিচে জোনাকিদের নৃত্যের মাঝে বটগাছের গর্তের ওদিকটায় এক ছায়া নড়াচড়া করে। দেখি পুরা গর্ত বালু দিয়া ভরা। দেখি, ঢালাপারের কাকতাড়ুয়া নদীতে তার শুকনা কটকটা ঠ্যাং ডুবায়ে গর্তে কী জানি ফিসফিসায়।

আমি তারে জিজ্ঞেস করি, কীরে ব্যাটা! মইদ্য রাতে এইনে কী? সে চমকায়, লজ্জায় অধোবদন হয়ে হাসে, যে চান্দের মত হাসি তারে আঁইকা দিছিল বাদলের বাপ; উত্তর দেয়না। উত্তর দেয়ার ক্ষমতাই নাই তার। ঢালাপাড়ে কাকতাড়ুয়া দাঁড়ায় আছে অনেক বছর ধরে, কিন্তু কখনও তারে ওইভাবে খেয়াল করি নাই। খেয়াল করার প্রয়োজনই মনে করি নাই হয়তো। খালি দেখতাম সে দিন রাত আইলের মাঝে দাঁড়ায় ভোদাইয়ের মত হাসে। পাহাড়া দেয় গমক্ষেত। শীতকালে ওইখানেতে রবিশস্য চাষ করে, ওই কয়দিন বাদলের বাপ ওরে ক্ষান্তি দেয়। নাম তার কাকতাড়ুয়া – কিন্তু কাঁক ওরে বালডাও মনে করে না। করবে ক্যান? কাকতাড়ুয়া যে সব সহ্য করে যায়, দাত কেলায়। কাকেরা ওর কান্ধে বসে, ল্যাদা দিয়া মাখায়, আরো নানা রং করে, সং করে। বাদলের বাপ তাই তারে লাঠি দিয়া ঠ্যাঙায়। হারামজাদা! কামিনা! কাম নাই, কাজ নাই, খালি ড্যাং ড্যাং।  তোরে কাম দিছি মাত্র একখান। কিচ্ছু করন লাগবো না, খালি খাড়ায়া খাড়ায়া কাক তাড়াবি। তা তুই কাকগো লগে সই পাইতা বইছস।

কাকতাড়ুয়া তাও কিছু বলে না। বেক্কলের মতো হাসে।

মাঝে মাঝে আবার দেখি, স্কুল ছুটি হইলে পোলাপান তারে বল্লার মতো ছাইকা ধরে। আজাগা-কুজাগায় হাত দেয়। গায়ে যে কাপড় থাকে, তা টাইনা ছিঁড়া ফালায়। পোলাপান পিশাচের মতো হো হো কইরা হাসে। কাকের মতো তারাও খুব মজা পায়। ন্যান্টা কাকতাড়ুয়া হাসে। বেশরম। হি হি হি।

কাকতাড়ুয়া কি সখে ন্যান্টা? কাকতাড়ুয়া কি সখে হাসে? তাও সে কিছু কয় না। মাইর খায়, গুতা খায়, কাই-কুইও করে না।

কাকতাড়ুয়ার সাথে তেমন কোনো ব্যক্তিগত স্মৃতি আমার নাই, শুধু একবার ওর গায়ে সাইকেল ঠেস দিয়া আমানত রাইখা গেছিলাম, এট্টুকই মনে পড়ে। কিন্তু যার মুখে এত হাসি, সে কেন মাঝরাতে বটগাছের তলে আসে সবার অগোচরে? কী এমন দুঃখ তার, যে সেই দুঃখের কথা লুকাইতে সে বালু চাপা দিতে দিতে পুরা গর্তই ভরে ফালায়? কৌতুহল হয়।

- কী কইলি বটগাছরে?

হাসি মুছে না, কিন্তু ভয় পায় যে, বুঝি আমি। আমি যে বটগাছের কথা জানি, কাকতাড়ুয়া তা জানতো না। একটুক্ষন সামনে পড়া ভুইলা যাওয়া অনুগত ছাত্রের মত দাঁড়ায় থাকে, যেন আমি ওর মাস্টার। কিন্তু ওর হাসির দিকে তাকায় আমার ভয় ভয় ধরে। ব্যাপারটা এমন না যে, ওর হাসিতে কোনো হিংস্রতাে আছিল, কিংবা আছিল রাগ; বস্তুত, ভয় পাওয়ার মতো কোনো কিছুই ওর হাসিতে আছিল না। ওর হাসি তো আমাদের বাদলের বাপেরই আঁকা – ও তো পারে না আর কিছু করতে, হাবাগোবা হাসা ছাড়া। তবু, বটগাছের তলে, নক্ষত্রদের উপস্থিতিতে, আমার ওর হাসির দিকে তাকাইলে সব আবার জট পাকায় যায়। তারারা বসন্তের গাছের মত ঝুরঝুর কইরা ঝইরা যায়, জোনাকিরা পাগলায় গিয়া আগুনের ফুলকির মতো লাফায়, ঝিঝি পোকারা এমনভাবে জিকির করে যেন ওদের গায়ে কেউ আগুন ধরায় দিছে। বটগাছের হাওয়াও আর শান্ত করতে পারে না আমারে।

ওর থেকে চোখ ফিরায় নেই। উত্তর তো দিবে না, জানি। চলে যাইতে বলি তাই।  

বিনীতভাবেই, কাকতাড়ুয়া প্রস্থান করে। এক ঠ্যাং ফালায়, আবার পিছন ফিরা দেখে। আবার ফেলে পা আরেক, পিছন ফিরা দেখে আমি কী করি। ভয় পায় হয়তো, তার গোপন কথা আমি জাইনা ফেলি কি না।

অপেক্ষা করি, দিগন্তের ফাকে কাকতাড়ুয়া ঢুকে যাওয়া পর্যন্ত। আমি মানুষ, আমার তো কতই দুঃখ থাকতে পারে। মাঝরাতে বটতলিতে নিজের দুঃখ চাপা দিতে আমি তো আসতেই পারি মানুষ হিসাবে। কিন্তু বাদলের বাপের আঁকা হাসিরে ছলা কইরা কাকতাড়ুয়ার শুণ্য ঘটে কী এমন দুঃখ খেলা করে? কাকতাড়ুয়ার কি আত্মা আছে? কাকতাড়ুয়াকে কি আমাদের বাদলের বাপই বানায় নাই? সে-ই তো বানাইছে। কাকতাড়ুয়া তো আমরাই, সে খালি নকল করে শিখে আমাদের থেকে। সে কি বাদলের বাপের আঁকা হাসিরে মুইছা ফেইলা নকল করতে করতে আমাদের আত্মাও নকল করে ফেলল? সে কি অনুভব করে, আমার মাধ্যমে?

আমার তো জানতে হবে এসব। আমি তাই পা বাড়াই – গর্তের দিকে, পা টিপে টিপে, এমনভাবে, যেন আমি পাপী, যেন আমি মহাবিশ্বের বিশাল কোনো রহস্য আবিষ্কার করার শেষ সীমানায় এসে পৌছায়া গেছি, যেন কাকতাড়ুয়া তো কাকতাড়ুয়া, বাদলের বাপ তো বাদলের বাপ, আমার নাড়ি-শিরা-উপশিরায় কী রহস্য খেলা করে তা পর্যন্ত আজ জাইনা ফেলব আমি।

কিন্তু - গর্তে উঁকি মারার আগেই, ঝিঝি পোকারা জিকির থামায় দেয়, জোনাকিরা নিভে যায়, দমকা কালবোশেখি হাওয়ার ধাঁচে প্রবল এক জোয়ার আইসা কাকতাড়ার দুঃখসমেত গর্তের বালু সব ধুয়ে মুছে নিয়া যায়।